শনিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১৯


উৎসবের আমেজ

 

 

একটা পরিচিতির সুবাদে ২০১৮ সালের নভেম্বরে মণিপুরের ইম্ফল শহরে সাঙ্গাই উৎসবে আমন্ত্রণ পাওয়া গেল। সরকারি উদ্যোগে উৎসব, মেলা বসেছে। যেমন কলকাতায় শীতে মেলা বসে, সেইরকমই আর কি।

তার সাথে ইম্ফলের মাপাল কাংজেইবুং ক্রীড়াঙ্গনে খেলাধুলার আসর। মন্ত্রী আমলা রাজ্যপাল সমবেত। আমিও আমন্ত্রিত। দেশী বিদেশী খেলোয়াড়রা ক্রীড়াকুশলী প্রদর্শন করছেন এবং মণিপুরি লোকসংস্কৃতি সহ নৃত্যকলার প্রদর্শন। যথেষ্টই উপভোগ্য। সংস্কৃতিচর্চার বেশ শুভ উদ্যোগ নিয়েছেন কর্মকর্তারা যার উদ্দেশ্য ঐক্যস্থাপনএই কারণেই আমার মত সাধারণ ব্যক্তির আমন্ত্রণ। আসরে মণিপুরি সুখাদ্য পরিবেশিত হয়ে আরও ভাগ্যবান মনে করলাম নিজেকে।

 

 

 

 

একজন কর্মকর্তা কর্নেল রঞ্জন নিজে থেকে এসে আলাপ করলেন। অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক, ক্রীড়ামোদী। আলাপী এবং বড়ই দুঃখী। নিজের শোক ব্যক্ত করেন সহমর্মিতার আশায়। আমাকে নিজের গাড়িতে করে ঘোরাতে ঘোরাতে যা বললেন তা নিতান্ত ই বেদনাদায়ক।

ভদ্রলোকের তিন ছেলের মধ্যে মধ্যমটি ছিল শ্রেষ্ঠ। এমেরিকায় নিজের কোম্পানি খুলেছিল, লন টেনিস চ্যাম্পিয়ন ছিল কলেজে। এমেরিকায় সে থাকত। বন্দুকবাজের নিশানায় প্রাণ দিয়েছে বছর কয়েক আগে।

সজল নয়নে মেলা প্রাঙ্গনে নিজের মোবাইল থেকে দেখাচ্ছিলেন আমাকে নিজের পরলোকগত পুত্রের ছবিগুলো। কোনটা টেনিস খেলার, কোনটা অফিসএর কোনটা কলেজের। সবশেষে দেখালেন এমেরিকার আদালতের রায়। ৪১ বছর আর ৬ মাস কারাদণ্ড হয়েছে আততায়ীর। প্রবীণ ব্যক্তির কাঁধে হাত দিয়ে সমবেদনা জানালাম, কী আর করতে পারতাম! একেই নিয়তি বলে। ওঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মেলায় ফটোগ্রাফির বিপণি পত্তন করেছিল, সেখানেই বসলাম। চা আর পকৌড়া এল। কনিষ্ঠ পুত্র ডেনমার্কে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার।

 

যথেষ্ট উপভোগ করলাম উৎসব। আরও অনেকের সাথে আলাপ হলপ্রসিদ্ধ ডাক্তার চৌরজিৎ  সিংহ, জনপ্রিয় খেলোয়াড় বিমল সিংহ ও কাওবা সিংহ। দেখলাম মণিপুরের প্রাচীন লোকক্রীড়ার প্রদর্শন, মণিপুরি নৃত্য। ঘুরে দেখলাম ওখানকার জাদুঘর। কর্মকর্তাদের এই উদ্যোগ ও আয়োজনকে সাধুবাদ দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে ফেরার পালা।

বিমানের আসনে বসে বসে মনে হচ্ছিল বারবার-উৎসব উপভোগ যেমন করলাম তেমনই এক শোকাহতের প্রতি সহমর্মী হওয়ার সুযোগও ত পেয়ে গেলামসহমর্মিতার সংযোগও ত উৎসবের অঙ্গ। ছোটবেলায় পড়েছিলাম মেলার এক উদ্দেশ্য সহমর্মিতা – সেই সত্য যেন একবার প্রত্যক্ষ অনুধাবন করলাম।

এইরকম একটা উৎসবের আমেজ নিয়ে ফিরে এলাম যার রেশ হয়ত কিছুদিন থাকবে আর তারপর হারিয়ে যাবে ব্যস্ত জীবনে।

২৫/১২/২০১৮

রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৪

রাস্তার ধারের আলো

রাস্তার ধারের শেষ আলোটা
 তোমার ই মত চেয়ে চেয়ে থাকে আমার দিকে -
প্রতিরাতে ঘরে ফেরার সময় মোড় ঘোরার আগে,
আমি একবার করে তাকিয়ে দেখি।
তোমার মতই কিছু বলতে চায়
হয়ত অব্যক্ত ভাষায়।

আমার এই যত্সামান্য চাকরির রোজগার
আর আগামী বানানোর স্বপ্ন
তোমার সংসার সাজাতে অপারগ।
সবান্ধবে আমি সাজিয়ে নিয়েছি আরেক বড়  সংসার ,
অনাথ বালকদের আশ্রম - আমরা আগামী বানাতে চাই।
 সবই কি তুমি জানো ?  জানি না
কেন তুমি অমন করে চেয়ে আজো
কি যে দেখো আমার পানে।

রাস্তার ধারের আলোটা জানালা দিয়ে চেয়ে থাকে
যদি পারো আমাকে আর আমার বৃহত্তর সংসারকে
একটু আলো দিও।


রবিবার, ১ জুন, ২০১৪

কাল রাতের ঝরে হারিয়েছে প্রাণ
   আমার পোষা পাখী ,
ভোরের আলো ফুটল  যখন
আর সে দেয় নি ডাকি।
সকাল বেলায় চোখ মেলেছি
  পোহালো যবে  রাতি ,
 দেখি আমার এ শূন্য বিজন নিকেতনে
পক্ষগুলি ছড়িয়ে দিয়ে ভ্রান্ত অযতনে
পিঞ্জর ছেড়ে কোন সে দিশায়
চলে গেছে মোর একলা ঘরের সাথী। 

শুক্রবার, ৩০ মে, ২০১৪

মর্ম সন্ধান

নিজের মর্ম গভীরে
   যেদিন চেয়ে দেখলাম একবার
খুঁজতে চেয়েছিলাম অন্য এক জগৎ একঘেয়েমি কাটাতে।
দেখতে পেলাম এক মন্দস্রোতা নদী ,
পরিষ্কার ঝিলিমিলি জল।
ছোটবেলায় পড়া গল্পের মতন
তার তীরে এক তপোবন ;
নদীর জলে দেখা আমার ছায়া কী আমার ছোটবেলার মুখ ?
মনে পড়ছে না।
সেই পায়ে চলা পথ -
পায়ে পায়ে এগিয়ে চলি
দু পাশের শোভা দেখতে দেখতে আর
কল কাকলি শুনতে শুনতে ঐ পর্ণকুটিরের দিকে।
   শীতল ছায়া ঘেরা কুটিরে গিয়ে এগিয়ে গেলাম
সামনে বসে আছেন কোনো জ্যোতিস্মান মহাত্মা।
সান্নিধ্যে গিয়ে নিয়ে নিলাম ,
বরিষ ধারা মাঝে শান্তির বাণী।
ভুলে গেলাম বদ্ধ জীবনের
   গ্লানি ক্লান্তি খেদ ছিল যত -
হারিয়ে গেলাম কিছুক্ষণ।
সম্বিত্ ফিরে পেয়ে ফিরে আসার আগে
বলেছিলেন 'আবার এস , আবার।'



বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৪

খাপছাড়া দুনিয়ায়

কটক রোড দিয়ে পুরীর দিকে যাবার পথে ভুবনেশ্বর শহর ছাড়িয়ে ৪ কিলোমিটার মধ্যেই গাড়ি ডান দিকে ঘুরে গেল।  জায়গার নাম চক্রপদা। কোথায় যাব জানি না , প্রশ্ন না করেই দুপাশের মাঠঘাট দেখতে লাগলাম ডাক্তারবাবুর পাশে বসে।

দুদিন আগেই এক ভয়ানক অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। আমাদের বেসরকারী নার্সিং হোমে ভাঙচুর হয়ে গেছে ব্যাপক ভাবে। ডাক্তার ব্যানার্জীর এই নার্সিং হোমে  এমন ঘটনা এই প্রথম। একটি ইনজেকশন দেবার পরে এক রোগীর আকস্মিক অভাবিত মৃত্যু হয়ে যায়। এতে ডাক্তার বেচারীর কোনো দোষ ছিল না।  কিন্তু উত্তেজিত জনতা আমাদের এখানে আক্রমন করে। আমি এখানে চার মাস হলো PRO হয়ে এসেছি ; ডাক্তার ব্যানার্জী আমাকে অকুস্থল থেকে সরিয়ে নিয়ে যান এবং কোনরকম বাধা দিতে কিম্বা বচসা করতে বারণ করেন। কান্ড সমাপ্ত হলে আমরা ফিরে গিয়েছিলাম সব দেখাশোনা করতে।
সন্ধ্যাবেলা ডাক্তারবাবুর কামরায় ওঁর সঙ্গে বসে ছিলাম। বিশেষ কোনো কথাবার্তা হয়নি। আজ সকালে উনি বললেন 'চল রায় , আজ তোমাকে একটা জিনিস দেখাই' . তারপর এই বেরিয়ে পড়া।

এ রাস্তায় গাড়ি বেশি নেই।  শুধু মোটর সাইকেল। দুপাশের শ্যামলিমা রোদে যেন আরো চকচক  করছে। 'আর মিনিট পনেরো ' বললেন ডাক্তারবাবু।

আমরা পৌঁছলাম একটা পাঁচিল ঘেরা বাগানবাড়ির সামনে।  গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম গেট খুলে। বাচ্চাদের কলরব কানে এলো। বাড়ির দিকে যেতেই এক ভদ্রমহিলা ডাক্তারবাবুকে ডেকে  নিয়ে গেলেন, আমি অনুসরণ করলাম। এটা একটা ইস্কুল।

'আমি এখানে বাচ্চাদের রেগুলার চেক আপ করতে আসি '- বললেন ডাক্তারবাবু। 'এটা হলো অবৈতনিক এক অনাথ আশ্রম। এদিকে চলে এস ' .
আমরা ঢুকলাম একটা ঘরে - অফিসঘর। অল্পবয়েসী আমার মত একটি ছেলে বসে , দেখে হেসে বসতে বলল। ছেলেটি বিহারী। ডাক্তারবাবু জানালেন তিন বছর হলো ছেলেটি এই অনাথ আশ্রম খুলেছে। ওর বাবা আই এই টি র অধ্যাপক ছিলেন।  ও আই  আই টি থেকে পাশ করে নিজের মাথা খেয়ে অবৈতনিক অনাথ আশ্রম বানিয়ে বসেছে।

আমরা আলাপ করলাম।  ডাক্তারবাবু কাজে চলে গেলেন। আলাপ করে ভালো লাগলো। কিন্তু ছেলেটি মৈত্রীপূর্ণ ব্যবহার করতে জানে না - কাজে ব্যস্ত ব্যস্ত ভাব সবসময়। আমাকে ঘুরে দেখালো তার আশ্রম। বলল সরকারী অনুদানেই আশ্রম চলে কোনরকমে।

প্রায় ঘন্টা তিন কেটে গেল ওখানে। ডাক্তারবাবু ফিরে বললেন 'কেমন লাগলো ? চল এবার ফেরা যাক। '
গাড়িতে উঠে বসলাম আমি আবার আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। ডাক্তার বাবুর এহেন যন্ত্রণা উপশমের উপায় দেখে বিস্মিত হলাম - কতরকম যে হয় মানব চরিত্র ! কখনো কখনো মনে হয় এদের সাথে আগে কেন দেখা হয়নি , আবার কখনো মনে হয় এ আপদ কবে বিদায় হবে।

যারা দুদিন আগে ডাক্তারবাবুকে হেনস্থা করেছিল তারা ওঁর এই কর্মপন্থা কী জানে ? জানলে কী  ও কাজ করত ? আমি নিজে কখনো পারব ? মানবচরিত্রের খবর কতদূর কে রাখতে সক্ষম হয় ? যতই দিন যাচ্ছে , ইন্টারনেট , ইমেইল , মোবাইল সব দূরত্ব মুছে দিচ্ছে।  কিন্তু এই খাপছাড়া দুনিয়ায় মানসিক দূরত্ব এখনো একই রকম। লোকে খাপছাড়া কান্ডে নিজের বিচার বুদ্ধি কাজে লাগানো ছাড়া কোনো উপায় খুঁজে পায়না। মনের প্রসার হয়ত আরো অনেক যুগের প্রয়াসের আবশ্যক পরিণতি।



রবিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৪



 প্রখ্যাত রহস্য লেখক হেমেন্দ্র কুমার রায়ের পিতা দিনেন্দ্র কুমার রায় লিখিত জার্মান রাজা কাইজার এর ব্যক্তিগত চরিত্র পড়তে পড়তে অকস্মাৎ একটা জায়গায় থমকে গেছি।  যুদ্ধের নায়ক রাজা মহাশয়ের নিজস্ব একজন রূপকার ছিলেন - যিনি ওই বহুকথিত গুম্ফের আবিষ্কর্তা।



রূপকার বলতে আমি কি বোঝাতে চাইছি সেটা নিশ্চয় স্পষ্ট এখন।
সেই নরসুন্দরের নাম হলো হের হাবি।  হাঁ , দিনেন্দ্র কুমার নরসুন্দর কথাটাই ব্যবহার করেছেন।  তাহলে দেখা যাচ্ছে সৌন্দর্যচর্চা আর সৌন্দর্যসেবা ব্যাপারটা নিতান্ত আধুনিক নয়। নরসুন্দর কথাটিও তো তত্সম , তাহলে আজকের বিউটি থেরাপিস্ট দের ও একটা সুপ্রাচীন ঐতিহ্য আছে বলে মানতে হবে।  নরসুন্দর সমাস কী ? মাস্টারমশাই রা ক্লাসঘরে পড়া  ধরে আলোচনা করতে পারেন।  কিন্তু যদি কথাটার লিঙ্গান্তর করার চেষ্টা করা হয় ? কোনো মহিলা তো রাজার রূপের দায়িত্ব নিতেই পারেন রানিমায়ের অনুমতি নিয়ে অথবা  রানিমা নিজেই করতে পারেন।  তাঁকে কি বলা হবে? আবার রানিমায়ের রূপের  পরাকাষ্ঠা দেখাতে স্ত্রী বা পুরুষ উভয়েই যত্নবান হতে পারেন।  তখন তাঁকে কী বলা হবে ? খুব গোলমালে পড়া গেল দেখছি !
গুম্ফ হলো মানব শরীরে পুরুষের লক্ষ্মণ, পৌরুষের আস্ফালন প্রকাশ করতে বরাবর পুরুষ গুম্ফ পরিচর্যা করে এসেছে  যেমন নিজের কাঁধে লাগিয়েছে বীরত্বদ্যোতক পদক।  হিটলার তাঁর গোঁফ নিয়ে অসংখ্য চিত্র আলোকিত করে আছেন, তিনিও জার্মান এবং স্বভাব চরিত্র অদ্ভূত ভাবে আমাদের পূর্বোক্ত রাজার অনুরূপ।  প্রথমজন প্রথম ও দ্বিতীয় জন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রবক্তা। জনৈক রুশ রাষ্ট্রপতির গোঁফ তো রসিকতার কারণ ছিল; তিনি নাকি সহ্য করতে পারতেন না আর কেউ সেরকম গোঁফ রাখলে - এই নিয়েও রসিকতা প্রচুর আছে।
দিনেন্দ্র কুমার লিখেছেন হাবি একটি আরক তৈরী করতেন ঐ গোঁফের জন্য যা সর্বসাধারণের জন্য নিষিদ্ধ ছিল।  কিন্তু সুচতুর হাবি করলেন কি , ফ্যাশন এর মর্ম বুঝে একরকম কাম্বিশের গুম্ফ কৌপিন  তৈরী করলেন। কায়দা করে ভেজা গোঁফটাকে সেই কাম্বিসের সাহায্যে বেঁধে দিতে হয় উর্ধ্বমুখী করে আর কৌপিন পড়তে হয় ওষ্ঠের ওপরে। ব্যস , হু হু করে তাই বিক্রি করে হাবি বেশ দু মার্ক করে নিলেন। রাজামশাই দেশ শুদ্ধ লোকের এহেন প্রহসন সহ্য না করে নিজের গোঁফ আবার অধোমুখী রাখলেন। প্রজারাও তাঁকে অনুসরণ করে মহাজনো যেন গতঃ সঃ পন্থাঃ ফের অবলম্বন করেছিলেন কিনা বইটাতে তা আর লেখা নেই। এ যেন আবোল  তাবোলের  সেই ছড়াটাকে মনে পড়িয়ে  দেয় , তাই না ? শেষের দু লাইন তো মোক্ষম।

শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০১৪

শুধিয়ে শুধিয়ে হয়রান আমি
বারেবারে বসন্ত এসে চলে যায় নিরুত্তর-
হলুদ উষ্ণীষ মাথায় মন ভুলিয়ে মাতায় ,
তবু কহে না কো কভু।
কুসুম পিকরব বর্ণ গন্ধ  মন্দ মারুত্
আমিও কবে হব তার দূত
তেমনি ডাক দেব ফিরে ফিরে।
আমি হতে চাই না তো স্থবির বিজ্ঞ -
চির নবীনের পতাকা হাতে শুনব সবার গান।
এস এস সবে করি আহ্বান;
         নিয়ে এস মধুর সুঘ্রান , নিয়ে এস অশেষ প্রাণ।